মুন্সীগঞ্জে শীতকালীন শাকসবজি চাষাবাদে কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিদিন নিজস্ব জমি পরিচর্যা ও বিভিন্ন প্রজাতির শীতকালীন সবজির চারা রোপণ করতে শুরু করেছেন। এছাড়াও এ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে সবজির চারা উৎপাদন করা হয়। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে চারা বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও। চলতি মৌসুমে এক বীজতলায় ৩-৪ বার চারা উৎপাদন করা হয়ে থাকে। প্রতি মৌসুমে প্রায় আড়াই থেকে ৩ কোটি চারা উৎপাদন হয়। যা বিক্রয় করা হয় প্রায় ৩-৪ কোটি টাকা।
সবজির চারা উৎপাদনের জন্য মুন্সিগঞ্জ সমগ্র দেশের মধ্যে প্রসিদ্ধ। এখানকার চারা সব জেলার চেয়ে উৎকৃষ্ট। এখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার পাইকার ও কৃষক এসে সবজির চারা কিনে নিয়ে যান। কিন্তু এ বছর অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে চারা উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। এতে চারার দাম বেড়ে দেড়গুণ হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনে মুন্সীগঞ্জ দেশের মধ্যে প্রসিদ্ধ। মুন্সীগঞ্জ সদর ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার অনেক কৃষকরা শীতকালীন লাউ, কুমড়া, মরিচ, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ব্রোকলি চারা উৎপাদনের সাথে জড়িত। এই উৎপাদিত চারা প্রতিবছর বিক্রি হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। চলতি বছর মুন্সীগঞ্জ জেলায় ৪ হাজার ৯শ ৭ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪শ ২৩ মেট্রিকটন।
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কর্মকর্তা রনি দাস বলেন, শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদন লাভজনক পেশা। কয়েকটি এলাকার কৃষক চারা উৎপাদনকে প্রধান পেশা হিসেবে নিয়েছেন। চারা উৎপাদনে জৈবসার ও খৈল ব্যবহার করা হয়। এ কারণে চারার গুণগত মান ভালো। বেশি ফলন ও লাভের জন্য গাজীপুর, সাভার, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বরিশাল, শরিয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। জানা যায়, এখানে উৎপাদিত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ফুলকপি চারা। এ চারার মধ্যে- ৭৭৭, সিরাযুথি, হিমাযুথি, ফ্রেশ, স্নো হায়াইট, মারবেল, কার্তিকা, ষাইটশা, চালানি ষাইটশা রয়েছে। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার, রামপাল, বণিক্যপাড়া, রামশিং, বজ্রযোগিনী, দেওয়ান বাজার, টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আব্দুলাহপুর, বেতকা ও সোনারং গ্রামে ঘুরে দেখা যায় সেখানকার উঁচু জমিগুলোতে বীজতলা বানিয়ে সবজির চারা আবাদ করা হচ্ছে। এ সকল শীতকালীন সবজি চারা রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য উপরে বাশের চালা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ বিক্রির জন্য চারা তুলছেন।
এসময় তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে চারা উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়। ডিসেম্বর পর্যন্ত চারা উৎপাদন হয়। বীজ বোনার সময় থেকে ২৫-৩০ দিনের মধ্যে চারা বিক্রির উপযুক্ত হয়। এক মৌসুমে একটি বীজতলায় ২-৩ বার চারা উৎপাদন করা হয়।
ভট্রাচার্যেরবাগ গ্রামের কৃষক সিহাব শিকদার বলেন, আমি ৪২ শতাংশ জমিতে চারা উৎপাদন করছি। আমার ৭-৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ চাষে যেমন লাভ তেমনি বিনিয়োগও বেশি। এ বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারণে চারা উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গত ১৫ দিনে চারার দাম বেড়ে দেড়গুণ হয়েছে। এক হাজার কপি চারা ১ হাজার ৪০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে, যা ১৫ দিন আগে ছিল ৯০০ টাকা। এছাড়াও প্রতি হাজার টমেটো চারা বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার টাকা, যা আগে ছিল ২৫০০-২৭০০ টাকা।
তিনি বলেন, গত ৪ বছরে বীজের দাম বেড়ে ৩ গুন হয়েছে। চার বছর আগে ফুলকপি চারার বীজ ৩৯ হাজার টাকা কেজি কিনেছি, এখন সেই বীজ ১ লাখ টাকা কেজি।
আবু সাঈদ দেওয়ান নামে আরেক কৃষক জানান, এখানে চারা উৎপাদনে অনেক শ্রমের প্রয়োজন। গাছগুলোকে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। আগাছা পরিষ্কার রাখলে চারাগুলো আরও ভালো হয়।
মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, সদর ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার শতাধিকেরও বেশি কৃষক বেশ কয়েক বছর ধরেই এই চারা উৎপাদন করছে। এখানে উৎপাদিত চারা খুবই ভালো মানের। চারা বিক্রির সাথে যারা জড়িত সেইসব কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। যেসব কৃষক ভালো ফলন চান, তারা এখান হতে চারা নিয়ে দেশের যেকোনো প্রান্তে চাষ করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, এ বছর অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে চারা উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এখানকার কৃষকরা এক ধরনের মাচা দিয়ে এই চারা উৎপাদন করে। মূলত তাদের নেট দেওয়ার মতো আধুনিক যে প্রক্রিয়া এটা আমাদের দেশে এখনো সম্ভব হয়নি। তাই অতি বৃষ্টির কারণে এ বছর বেশ চারার ক্ষতি হয়েছে। এখানকার চারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে।