স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তবে তাদের অনেকের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। ইউরোপ নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়া ও তিউনেশিয়ার বিভিন্ন বন্দি শিবিরে রেখে চালানো হয় নির্যাতন। এরপর লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়। তবুও অনেকের মুক্তি মিলছে না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট পরিবারের।
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম এলাকার শুভ বাগচি (২২)। ৮ মাস আগে ভাগ্য বদলের আশায় ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বর্তমানের পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই। বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও জানে না পরিবারের লোকজন।
একই গ্রামের রবিন মল্লিক ৫ মাস আগে ইতালি যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়ে। কিন্তু তারও কোন সন্ধান নেই।
অপরদিকে কালকিনি উপজেলার পুর্ব আলীপুর গ্রামের জুবায়ের হাওলাদারকে ইউরোপে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তিউনেশিয়ায়। দফায় দফায় নির্যাতন করে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা।
শুধু শুভ, রবিন, জুবায়েরই নয়। লিবিয়া ও তিউনেশিয়ার বিভিন্ন বন্দি শিবিরে আটক রয়েছে শত শত বাংলাদেশি। তিউনেশিয়ার একটি বন্দি শিবিরে রয়েছেন আরও অর্ধশত বাংলাদেশী।
মাদারীপুরের পূর্ব আলীপুর গ্রামের জুবায়েরসহ বন্দিরা মুক্তির আকুতি জানিয়ে স্বজনদের কাছে একটি ভিডিও পাঠিয়েছেন। বন্দিরা নির্মম নির্যাতনের বর্ননা দিয়েছেন।
ভিডিও বার্তায় মো. ইয়াকুব নামে এক বন্দি জানান, তার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। তাকে ১০ লাখ টাকায় ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। প্রলোভনে পড়লে তাকে ভিজিট ভিসায় প্রথমে দুবাই তারপর ইথিওপিয়া তারপর নাইজার নেয়। এপর্যন্ত বিমানেই নেওয়া হয়। এরপর তিনদিন সড়ক পথে সেখান থেকে মরুভুমি পাড় হয়ে আলজেরিয়া নেয়। সেখানে আলজেরিয়ান পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এরপর এক মাস জেলখাটে ইয়াকুব। জেলের ভেতরেও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। জেল থেকে মুক্তি পেতে দালালচক্র আরও ৫ লাখ টাকা নেয়। এরপর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের তিউনেশিয়া নেওয়া হয়। সেখানে বসেই তাদের টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে আরও ৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। তাদের তালাবন্ধ একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে ঠিকমত খাবার দেওয়া হতো না। তাদের সাথে ৩৪ জনের একটি দল ছিলো বলে জানান ইয়াকুব।
ভিডিও বার্তায় ইয়াকুব আরও জানান, ভিজিট ভিসায় নেওয়ার কথা থাকলেও দালালরা তিউনেশিয়া থেকে তাদের অবৈধভাবে সাগর পথে বোটে করে ইতালি নেওয়ার প্রস্তাব করে এবং আরও ৭ লাখ টাকা দাবি করে। অবৈধ পথে যেতে এবং টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাদেরকে বিড়ির আগুন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝলসে দেওয়া হয়। আঙ্গুলের নখ টেনে তুলে ফেলে। আঙ্গুলের মাথা কেটে ফেলা হয়। এই নির্যাতনের সাথে জাহিদ, হোসেন, সাইফুল, মফিজ নামে বাংলাদেশি দালাল জড়িত বলে জানান তিনি। দালালদের মধ্যে মফিজের বাড়ি মাদারীপুর। মফিজই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে বলেও জানান তিনি।
ভিডিও বার্তায় নির্যাতনের শিকার মাদারীপুরের আলীপুরের বাসিন্দা জুবায়ের হাওলাদার বলেন, এই দেখেন আমারে বিড়ির আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলেছে। এসময় ভিডিওতে নির্যাতনের ক্ষত দেখানো হয়। তিনি সরকারের কাছে বন্দি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি জানিয়েছেন।
নির্যাতনের শিকার ইয়াকুব বলেন, আমার সর্বশেষ সম্বল ২ শতাংশ জমি ছিলো। সেটা বিক্রি করে ওদের টাকা দিয়েছি। এখন আমার বউ বাচ্চা শ্বশুর বাড়ি থাকে। বসবাসের ভিটাটুকুও নেই। দফায় দফায় নির্যাতন করে ওরা ১৭ লাখ টাকা আদায় করেছে। এরমধ্যে আমরা আলজেরিয়া ও তিউনেশিয়ার জেলে ৬৪দিন ছিলাম। সেখানে থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা দালাল মফিজের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের কাছে আরও ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। আমরা এতো টাকা কোথায় পাবো? দালালরা ইতালি নেওয়ার নাম করে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নেয়। এরপর নির্যাতন করে।
ভিডিও বার্তায় তিনি আরও বলেন, দালাল জাহিদ, হোসেন, সাইফুল, মফিজ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আদায় করে। তাদের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের লোকজন টাকা গ্রহণ করে থাকে। দালালরা যেহেতু দেশের বাইরে তাদের ধরা যাচ্ছে না। তবে দালালদের পক্ষ হয়ে যারা টাকা গ্রহণ করছে তাদের ধরা হোক। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
শুধু শুভ, রবিন, জুবায়ের নয়। অবৈধপথে ইতালি যাবার সময় লিবিয়া, তিউনেশিয়া, দুবাই, আলজেরিয়া, মরক্কো, নাইজেরিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে বন্দি রয়েছে শত শত বাংলাদেশি। তবে কতজন বন্দি আছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে জিম্মি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম এলাকার অর্ধশত যুবক। তাদের নির্যাতন করে দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি।
শুধু আমগ্রাম নয়, মাদারীপুর সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের মতলেব ফকিরের ছেলে শাকিব ফকির, বাদশা হাওলাদারের ছেলে হাসান হাওলাদার, সালাম হাওলাদারের ছেলে নুর আলম হাওলাদার, জব্বার হাওলাদারের ছেলে বেল্লাল হাওলাদার, মোক্তার মোল্লার ছেলে জসিম মোল্লা, এনামুল হাওলাদারের ছেলে নয়ন হাওলাদার, সামচু সরদারের ছেলে হৃদয় সরদার, সেকেন্দার আলী সরদারের ছেলে সাইফুল সরদার, গোলাম ফারুক সরদারের ছেলে মোস্তাফিজুর সরদার, আমির লাল ফকিরের ছেলে শাহীন ফকির, দুলাল মোল্লার ছেলে আরমান মোল্লাসহ অর্ধশত যুবক এই নির্যাতনের শিকার ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা গ্রামের স্বপন কয়েক মাস আগে ভাগ্য ফেরাতে অবৈধপথে ইতালি যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন। লিবিয়া পৌঁছে ধরা পড়েন মাফিয়াদের হাতে। মুক্তিপণ হিসেবে মাফিয়ারা দাবি করেন ৩০ লাখ টাকা। স্বামীকে বাঁচাতে ভিটেমাটি বিক্রি করে দফায় দফায় ২০ লাখ টাকা এনে তুলে দেন দেলোয়ার সরদার নামে এক দালালের হাতে। তবে, এখনও দেশে ফেরা অনিশ্চিত স্বপনের।
স্বজনদের অভিযোগ, প্রলোভন দেখিয়ে রাজৈরের আমগ্রাম এলাকার আরিফ ও মমরাজ বেপারী নামে দুই দালাল বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
মাফিয়াদের হাতে জিম্মি শুভ বাগচীর মামা অপূর্ব বৈদ্য বলেন, ধাপে ধাপে দালাল মমরাজ বেপারী ২২ লাখ টাকা নিয়েছে। জমি জিরাত বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। এখন আর টাকা দেওয়ার উপায় নেই। আমার ভাগনে এক সপ্তাহ ধরে কেমন আছে, তাও জানি না।
লিবিয়ায় বন্দি রবিনের মা বলেন, আমার ছেলেকে মাফিয়ারা জিম্মি করে রেখেছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। মার খেতে খেতে তার শরীরে পচন ধরেছে। কিন্তু আমার ছেলেকে মুক্তি দিচ্ছে না। এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
বিষয়টি নিয়ে মাদারীপুরের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র কামরুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের ফেরত আনার বিষয় সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে পত্র প্রেরণ করা হবে।