উরুগুয়ের বিপক্ষে পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে ব্রাজিলের কোপা আমেরিকা মিশন। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের এই আসরের শুরুর দিকে ভক্ত-সমর্থকদের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন ব্রাজিলের অধিনায়ক দানিলো। ‘দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’-এ প্রকাশিত সেই চিঠির চুম্বকাংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
আজ মন খুলে কিছু কথা বলি। অনেক দিন ধরেই আমরা যথেষ্ট ভালো খেলতে পারছি না। তার মানে এই নয় যে চেষ্টা করছি না, নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছি না, পরাজয়ের বেদনা অনুভব করছি না। ব্রাজিলের জন্য আমরা নিজেদের উজাড় করে দেই। এই জার্সির জন্য আমরা কতটা আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত, সেটা ঠিক বুঝাতে পারছি না। কোপা আমেরিকায় আমার লক্ষ্য, অন্তত এটুকু যেন বোঝাতে পারি।
বেশ, এবার আপনাদের পালা। হোটেল-রেস্তোরাঁয় যখন ফুটবল নিয়ে আলোচনা হয়, বন্ধুদের কী বলেন? গণমাধ্যমে কী বলেন? কী ভাবেন আমাদের নিয়ে?
‘ওদের কিছুতেই কিছু যায়–আসে না।’
‘ওরা আসলে জয় চায় না।’
‘এরা সব ধনীর দল, জার্সির জন্য কোনো ভালোবাসা নেই।’
আপনারা কেন এসব বলেন আমি বুঝি। পৃথিবীর সব জায়গায় সমর্থক ও খেলোয়াড়দের মাঝে একটা দেয়াল আছে। ইনস্টাগ্রামে ঢুকলে কী দেখেন? সবাই সুখী। যেন সবাই সমুদ্রসৈকতে সময় কাটাচ্ছে। আপনাদের এই কল্পনার জগত তৈরীতে আমি নিজেদের দায় দেখছি। তাই কাউকে দোষ নিয়ে দিতে চাই না। কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে এটুকু বলতে পারি, প্রত্যেক খেলোয়াড় ওই হলুদ জার্সির ওজনটা অনুভব করে।
‘এটা শুধুই আরেকটা ম্যাচ। চাপ গায়ে মাখছি না। আমরা পেশাদার খেলোয়াড়’, এই কথা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি স্রেফ। এটা ফালতু কথা। বাস্তবতা হলো, দলটার নাম ব্রাজিল, চাপ না থাকে কী করে!
ব্রাজিল অনূর্ধ্ব–২০ দলে ডাক পাবার দিনটা কখনো ভুলবো না। রাতভর শুধু ভাবছিলাম, লকার রুমে ঝোলানো আমার জার্সিটা দেখতে কেমন হবে? হলুদ, না নীল? চেয়েছিলাম যেন হলুদ হয়! পরদিন টেনশনে তিনবার জুতা পরিষ্কার করে ফেললাম। অবশেষে যখন লকার রুমে গেলাম, দেখলাম – ‘দানিলো ২’।
কটকটে হলুদ জার্সি, সবুজ সংখ্যায় লেখা নাম। সেদিন মনে মনে নিজেকে বলছিলাম, জীবন দিয়ে খেলো। নিজের সবটুকু দাও। বন্ধুর জন্য, পরিবারের জন্য। যারা এত দূর আসতে তোমাকে সাহায্য করেছে, সবার জন্য। দেশের জন্য। তুমি পারবে!
কিন্তু মাঠে নামার পর মনে হলো, ফুটবলে লাথি দেওয়াই ভুলে গেছি! এতোটাই চাপ অনুভব করলাম যে, সামান্য একটা পাস দিতে গিয়েও বল গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। জার্সির ওজন মনে হচ্ছিল ৫০ কেজি। টানা ৫০ মিনিট জীবনের সবচেয়ে বাজে ফুটবল খেলেছি। মাঠ থেকে উঠিয়ে নিয়ে কোচ যেন আমাকে নতুন জীবন দিলেন।
কিন্তু জানেন? যখন মাঠ ছাড়লাম, আমার দুঃখ হচ্ছিলো না। নিজের ওপর রাগও না। কারণ, বুকে হাত রেখে বলতে পারি, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার করার ছিল না। আমি জীবন বাজি রেখে দৌড়েছি। মনে হচ্ছিলো, এটা যদি ব্রাজিলের হয়ে আমার শেষ ম্যাচও হয়, অন্তত যেন নিজের সবটা দিয়ে যেতে পারি।
ফুটবলে সবটা ঢেলে দিলেও অনেক সময় আসবে, যখন আপনার পা কথা শুনবে না, অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম থেকে উঠবেন, সারা পৃথিবী আপনাকে ঘৃণা করবে। যখন মনে হবে—আমি এই জার্সির যোগ্য নই। সেই অনুভূতি আমি খুব ভালো করে জানি।
রিয়াল মাদ্রিদে প্রথম মৌসুমেও ভীষণ হতাশ ছিলাম। মনে হচ্ছিল, একটা জায়গায় আটকে গেছি। ইচ্ছা হচ্ছিলো, ফুটবল খেলা ছেড়ে দিই। জার্নালে লিখেও ফেলেছিলাম: মনে হয় ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে।
শিশু বয়সে আপনি যখন ফুটবল খেলেন, তখন কিন্তু অতো কিছু ভাবতে হয় না। শরীর ও মনের সামঞ্জস্য থাকে। সহজ কথায়, ভুলকে আপনি খুব একটা আমলে নেন না। শুধু খেলাটা উপভোগ করেন। কিন্তু নিজেকে বড় খেলোয়াড় ভাবলেই চাপ এসে ঘিরে ধরে। ভুল হতে থাকে। সেই থেকে চাপ নেওয়া ছেড়ে দিলাম।
নিজেকে ৩১ মিলিয়ন ইউরোর দানিলোর বদলে ব্রাজিলের বিকাস অঞ্চলের ছোট্ট দানিলো মনে করা শুরু করলাম। যে কিনা পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা পিৎজা কিনে ভাগ করে খেতো। ইন্টারনেট ক্যাফেতে একটু কম খরচে ই–মেইল করার জন্য মালিকের হাতে-পায়ে ধরতো। প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তেলাপোকা, মাকড়সা, বিচ্ছুর সঙ্গে ঘুমাতো।
আমরা ব্রাজিলের মানুষের আবেগের মূল্য দিতে চাই, যারা আমাদের সমালোচনা করেন, সামনের দিকে ঠেলে দেন, আমরাও আপনাদের লড়াই করতে চাই। যারা সত্যিকার অর্থেই আমাদেরকে ভালোবাসেন, আমাদের দলটা নিয়ে ভাবেন। আমরা নতুন জুতা দেখাতে কিংবা সেলফি তুলতে আসিনি। বরং ভক্তদের দেখাতে এসেছি, আমাদের শিরা-উপশিরায় জয়ের তীব্র নেশা চেপে বসেছে।
অধিনায়ক হিসেবে আমি চাই, আমাদের দলটা দেশের জন্য কি করতে পারে সেটা দেখিয়ে দিক। ব্রাজিলের জার্সির ওজনটা দেখানোর জন্য কোপা আমেরিকা আমাদের জন্য সেরা সুযোগ। আমরা ব্রাজিলের মানুষের জন্য আরেকবার লড়াই করতে চাই। এটাই আমাদের পরিচয়; লড়াই করো, জিতে আসো, পরাজয় কভু নয়। আমরা কোপা আমেরিকায় লড়াই করতেই এসেছি।