ইনসেটে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান
স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন, অর্থের বিনিময়ে বদলি-পদোন্নতি-নিয়োগ, মামলা বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে শাস্তি মওকুফসহ পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সকল খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে এসব অভিযোগ তুলেছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মো. জামিনুর রহমানের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির মূল হোতা। তার সঙ্গে রয়েছেন সিস্টেম এনালিস্ট আল্লামা মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া তানহার ও মো. শাহেদ আলমগীর। তারা ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার ও সীমাহীন দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য, অবৈধ কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করে তাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এমডি ও তার সহযোগীরা নির্যাতন, হুমকি, হেনস্তাসহ অবৈধভাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতা খাটিয়ে ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে দীর্ঘদিন ধরে একপ্রকার জিম্মি করে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরইমধ্যে ১৪ এবং ১৫ আগস্ট দুই দফায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর অভিযোগপত্র দিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে অবৈধভাবে উচ্চমূল্যে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে ব্যাংকের অর্থ ও সম্পদের ক্ষতি, স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন, অভ্যন্তরীণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উত্তরপত্র টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ঘুষ বাণিজ্যি, অর্থের বিনিময়ে বদলি-পদোন্নতি-নিয়োগ, মামলা বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে শাস্তি মওকুফসহ প্রতিষ্ঠানটির সকল সেক্টরে দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার মতো বহু অভিযোগ রয়েছে ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন। এজন্য পেশীশক্তি খাটিয়ে ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিম্মি করার রাখার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ছুটির দিন শুক্রবার ব্যাংক বন্ধ থাকলেও অর্থের বিনিময়ে জেলা কর্মকর্তাদের শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু, অর্ডারে উল্লেখ করেছেন ১৫ আগস্ট (বৃহস্পতিবার)। এছাড়া, তাড়াহুড়ো করে জনপ্রতি ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে মাঠকর্মীদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়াও চালাচ্ছেন তিনি।
ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাইজিংবিডিকে বলেছেন, কয়েকদিন ধরেই ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী এমডি ও দুর্নীতিবাজ অন্যান্য কর্মকর্তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। কিন্তু, এমডি এই বিক্ষোভ দমনে অনৈতিকভাবে ঢাকার বাইরের মাঠকর্মীদের জিম্মি করে প্রধান কার্যালয়ে আসার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন এবং আন্দোলনরত সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছেন।
সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করছেন, সম্প্রতি ৪৯২ জন অফিস সহকারী ও ৭২ জন নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগে বাণিজ্য করেছে এমডির সিন্ডিকেট। এই নিয়োগে জনপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আরও অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর হোম লোন অনুমোদনের জন্য ২ লাখ টাকা করে কমিশন নেওয়া হয়। মোটরসাইকেল লোন দেওয়ার সময় কমিশন নেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা। ব্যাংকের ল্যাপটপ ২ লাখ টাকা করে ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য মাত্র ৭০ হাজার টাকা। প্রধান কার্যালয়ে ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকারী এমপ্লয়িদের দুপুরের খাবার বাবদ ৪০০ টাকা বিল করা হয়। অথচ, সরবরাহকৃত খাবারের প্রকৃত মূল্য ১০০ টাকা। কর্মীদের সাসপেনশন তুলতে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা নেওয়া হয়। পদ অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্কের টাকার বিনিময়ে (১ থেকে ৫ লাখ) বদলি করা হয়। ব্যাংকের সকল শাখা অফিস, জেলা অফিস ও প্রধান কার্যালয়ে ৬০০ অ্যাটেনডেন্স মেশিন কেনা হয়েছে। যার প্রতিটির প্রকৃত মূল্য ১১ হাজার টাকা। অথচ, বিল দেখানো হয়েছে প্রতিটি ২৮ হাজার টাকা করে। এছাড়া, ভুয়া বিল, টেন্ডার বাণিজ্যসহ ব্যাংকের প্রায় প্রতিটি খাতে এমডি অপকর্ম করছেন।
ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, এসব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অনেক বার চিঠি দেওয়া এবং অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ব্যাপক বৈষম্য, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের বিষয়ে তিনি কোনোরকম পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণ অপারগতা প্রকাশ করেন। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মো. জামিনুর রহমান নিজে এই সীমাহীন দুর্নীতি, অবৈধ কেনাকাটা, স্বৈরাচারিতায় নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। তার কাজে সহযোগিতার জন্য অত্যন্ত অনুগত সিস্টেম এনালিস্ট আল্লামা মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া তানহার, সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট মো. শাহেদ আলমগীরকে নিয়ে একটি শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি করে অব্যাহতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম, লুটপাট, দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
এরকম পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার নিশ্চিতকরণ, বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক নিশ্চিত করতে ব্যাংকের সকল স্তরের সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইউ, এনবিআর ও সংশ্লিষ্ট বিধিবদ্ধ সংস্থা কর্তৃক সকল রকমের তদন্ত পরিচালনার জন্য তারা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন। তদন্তকালে অভিযুক্ত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যাতে অভিযোগকারী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হয়রানিমূলক বদলি, বরখাস্ত, অব্যাহতি, হুমকি বা হেনস্তা না করে, সে দাবি জানানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমানের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দেখা করতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মকর্তার মাধ্যমে জানান যে, তিনি ব্যস্ত আছেন। পরে তার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।