প্রতিদিনের মত গত ১৮ জুলাইও কাজে বের হয়েছিলেন দিনমজুর আব্দুল বারেক (৬৫)। হঠাৎ শুনতে পান পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ চলছে। জানতে পারেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার নাতি মেহেদী হাসান আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। নাতিকে খুঁজতে দৌড়ে যান সংঘর্ষের স্থানে। এ সময় পুলিশের ছোঁড়া অসংখ্য ছররা গুলি এসে লাগে আব্দুল বারেকের চোখসহ শরীরের নানা অংশে। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহে পাঠানো হয়।
দীর্ঘদিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরলেও পুলিশের গুলিতে বারেকের এক চোখ চিরতরে দৃষ্টিহীন হয়ে গেছে। অপর চোখটিও নষ্টের পথে। ব্যাথায় যন্ত্রণায় বিছানায় ছটফট করে জীবন কাটছে তার। এ পর্যন্ত লাখ টাকা ধারদেনা করে চিকিৎসা করালেও টাকার অভাবে বর্তমানে তার চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। এভাবে অচল অবস্থায় ঘরে পড়ে থাকলেও খোঁজ খবর নেয় না কেউ।
আহত বারেক মিয়া নেত্রকোনার মদন উপজেলার চানগাও ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল গণি মিয়া ছেলে। বারেক মিয়া তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বহু আগেই। তিন ছেলেও বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। বারেক মিয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদাভাবেই বসবাস করছিলেন। দিনমজুরি কাজ করে প্রতিদিন যা রোজগার হতো তা দিয়েই সংসার চলত তার। বর্তমানে তিনি নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন। চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করে খরচ করেছেন প্রায় লাখ টাকা। একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাকী চোখটাও নষ্টের পথে। চিকিৎসক জানিয়েছে, নষ্ট চোখ তুলে ফেলতে হবে। নয় তো বাকী চোখটাও দ্রুত সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু চোখ তোলার জন্য অস্ত্রোপচারের জন্য নেই টাকা। তাই টাকার অভাবে ঠিক মতো আব্দুল বারেকের চিকিৎসা না হওয়ায় পরিবারটি এখন অন্ধকারের পথে।
গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসাবে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি দেন শিক্ষার্থীরা। সেই কর্মসূচির সমর্থন জানিয়ে মদন উপজেলার সাধারণ শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টা থেকে মদন সরকারি কলেজ মোড়ে জড়ো হতে থাকে। একই সঙ্গে পুলিশও সেই স্থানে অবস্থান নেয়। বেলা ১১টার দিকে আন্দোলকারী শিক্ষার্থীরা একটি মিছিল নিয়ে উপজেলা পরিষদের দিকে আসতে থাকে। পরে পুলিশ ডাক বাংলো মোড়ে বেরিকেড দেয়। পুলিশের বেরিকেড ভেঙেই শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে পাবলিক হলের দিকে রওনা হয়। একই সময় আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে আওয়ামী লীগের অঙ্গসহযোগী সংগঠন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। দুইটি মিছিল উপজেলা খাদ্য গুদামের সামনে মুখোমুখি হলে প্রশাসন মিছিল দুইটিকে ছত্রভঙ্গ করে আলাদা করে দেয়। পরে শিক্ষার্থীরা শহীদ আব্দুল কদ্দুছ মগড়া সেতুর পূর্ব পাড়ে অবস্থান নেয়। এসময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দলের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে যোগ দেন। এ সময় নাতিকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশের ছোঁড়া ছররা গুলিতে আহত হন বারেক মিয়া। একই সময় আরও ১২-১৩ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশত লোকজন আহত হয়।
আব্দুল বারেক বলেন, নাতিকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে চোখ হারিয়েছি। আহত হওয়ার পর থেকে কাজ কর্ম করতে পারি না। চিকিৎসার জন্য লাখ টাকা ঋণ করেছি। একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে নষ্ট চোখ তুলে ফেলতে হবে। কিন্তু টাকার অভাবে চোখ তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এখন ভালো চোখেও ব্যাথ্যা শুরু হয়েছে। সময় মতো চোখ তুলতে না পারলে ভালো চোখও নষ্ট হয়ে যাবে। কি করবো? কোথায় যাবো বুঝতেছি না।
মদন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও চানগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল আলম তালুকদার জানান, ১৮ জুলাই পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের স্থানে আব্দুল বারেক গুলিবিদ্ধ হয়। তার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে বারেকের পরিবার খুবই কষ্টে দিনযাপন করছে। আব্দুল বারেক ছাড়াও উপজেলায় আরও অনেক লোকজন আহত হয়েছেন। আমরা আহতের তালিকা তৈরি করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। আহতরা যাতে সহযোগিতা পায় তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।