ইসরায়েলের হামলায় ইরানের দুই সেনা নিহত হয়েছেন বলে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থার বরাত দিয়ে খবর দিয়েছে বিবিসি।
শনিবার ভোরে ইসরায়েলের ‘প্রতিশোধমূলক’ এই হামলার সময় ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলা করতে গিয়ে তারা নিহত হয়েছেন বলে তথ্য দিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
বিবিসি লিখেছে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা দেশটির সেনাবাহিনীর একটি বিবৃতির বক্তব্য উদ্ধৃত করে এই তথ্য দিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, “ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সেনাবাহিনী, ইরানের নিরাপত্তা রক্ষায় এবং জনগণ ও ইরানের স্বার্থ রক্ষায় অপরাধমূলক ইহুদিবাদী শাসকদের কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলা করার সময় তাদের দুজন যোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছেন।”
শনিবার (২৬ অক্টোবর) স্থানীয় সময় ভোরে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। রাজধানী তেহরানে শোনা যায় বেশকিছু বিকট বিস্ফোরণের শব্দ।
‘সুনির্দিষ্ট’ সামরিক স্থাপনা ও অবকাঠামোতে হামলা চালানো হয়েছে বলে তেলআবিব দাবি করেছে। অবশ্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ-হামলার হুমকি দিয়েছে তেহরান।
টাইমস অব ইসরায়েল লিখেছে, ইরান হামলা পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তেলআবিবে কিরিয়া সামরিক ঘাঁটির বাঙ্কারে বৈঠক করেছেন।
এরপর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আবার ইরানকে হুঁশিয়ার করে পাল্টা হামলা চালানোর পথ না খোঁজার জন্য সতর্ক করেছে।
টাইমস অব ইসরায়েল লিখেছে, বৈঠকের পর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আইডিএফ এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি ইরানে তাদের হামলার সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন।
অবশ্য ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর বরাত দিয়ে শনিবার পার্স টুডে লিখেছে, রাজধানী তেহরান, খুজিস্তান ও ইলাম প্রদেশের বিভিন্ন স্থাপনায় ইসরায়েল যে হামলা চালিয়েছে, তা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
“ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের হামলা ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। তারপরও কিছু ক্ষেত্রে সামান্য ক্ষতি হয়েছে”, লিখেছে সংবাদমাধ্যমটি।
বিবিসি লিখেছে, ইরানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের হামলার বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যার কযেকটি যাচাই করা হয়েছে।
ভিডিওগুলো যাচাই করে বিবিসি বলছে, হামলার সময় অন্ধকার থাকায় এগুলো যাচাই করা কঠিন। তবে ভিডিও থেকে তেহরানের হামলার স্থানের ভূমানচিত্র চিহ্নিত করতে পেরেছে তারা।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা লিখেছে, তেহরানে কয়েকটি শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। তবে, হতাহত ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনও জানা যায়নি।
বিবিসি লিখেছে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর থেকে মাসব্যাপী ইরান-সমর্থক গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণের জবাবে এই হামলা চালানো হচ্ছে।
ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর বরাত দিয়ে পার্স টুডে বলছে, তেহরান ও আশপাশের অধিবাসীরা বিস্ফোরণের যেসব শব্দ শুনতে পেয়েছে, সেগুলো ছিল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্রিয় হয়ে ওঠার শব্দ। হামলার শিকার তেহরানের লক্ষ্যবস্তুগুলোতে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
তেহরান থেকে আলজাজিরার রেসাল সেদার আতাস বলেছেন, “আমরা দেখেছি, ইরানের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বের বেশ কিছু এলাকায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, তবে হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল তেহরান।”
“ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ও ড্রোন স্থাপনা লক্ষ্য করে প্রধানত হামলা চালানো হয়েছে।”
বিবিসি যে ভিডিওগুলো যাচাই করার দাবি করেছে তার মধ্যে তেহরানের উত্তরাঞ্চলের ভিডিও রয়েছে, যাতে হামলার স্থান শনাক্ত করা হয়েছে।
সিরিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, শনিবার দেশটির মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় কিছু সামরিক স্থাপনাতেও হামলা করেছে ইসরায়েল।
ইরানের গণমাধ্যম হামলায় সামান্য ক্ষতি হওয়ার দাবি করলেও আলজাজিরা লিখেছে, সব রুটে বেসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে দেশটিতে।
বিবিসি লিখেছে, ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমগুলো ‘পরিস্থিতি শান্ত আছে’- এমন একটি পরিবেশ দেখানোর চেষ্টা করছে।
তবে দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির সিনিয়র ফেলো বেহনাম বেন তালেবলু।
তিনি বলছেন, ইরানের কিছু টার্গেটে ইসরায়েল হামলা করলেও দেশটির দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হুমকিকে ‘সমূলে নিশ্চিহ্ন’ করার চেষ্টা করা হয়নি বলে তার মনে হয়েছে।
বিবিসি পার্সিয়ানের বাহমান কালবাসি বলছেন, ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতির কথা অস্বীকার করা হয়েছে। তারা ইসরায়েলের হামলা সফল হয়নি বলে দাবি করেছে।
তার মতে, ইরান সবসময়ই হামলার পর এমন দাবি করে থাকে। তবে পাল্টাপাল্টি হামলা বন্ধে এটি মুখরক্ষার একটি উপায়ও হতে পারে।
বিবিসি লিখেছে, হামলার পর ইরান ও ইরাকে সব বেসামরিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিলেও দুপুরের পর তা আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দেখাচ্ছে, ইসরায়েলি হামলার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি তেহরানের জনজীবনে; আবার সব মেট্রোসেবা চালু হয়েছে, ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হয়েছে।
লিসি ডুসেট বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক, যিনি লিখেছেন- তেহরানের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করা উচিত এবং পর্যালোচনা করে দেখা উচিত তারা যদি আবার ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়, তাহলে তার যে আরও কঠিন জবাব তেলআবিব দেবে, তা তারা মোকাবিলা করতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে দুজন সামরিক কর্মকর্তা সিবিএস নিউজকে জানিয়েছেন।
আলজাজিরা বলছে, হামলার পর হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া বিবৃতিতে ইসরায়েলের এই হামলাকে ‘হামলার জবাবে হামলা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন করে পাল্টা হামলা না জড়াতে তেহরান হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
ইসরাইলের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেছেন, গত কয়েক মাস ধরে ইরান যেসব হামলা চালিয়েছে তার জবাবে ইরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত হামলা চালানো হয়েছে। তিনি দাবি করেন, কয়েক দফায় এ হামলা চালানো হয়েছে এবং হামলা শেষে তার ভাষায় ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো তাদের ঘাঁটিতে ফিরে গেছে।
ইরনার খবরে বলা হয়েছে, ইরানের রাজধানী তেহরানসহ সারা দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তেহরানের অধিবাসীরা সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে যার যার কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নির্ধারিত সময়ে শুরু হচ্ছে। শুধু ইরানের সকল বিমানবন্দরের সকল ফ্লাইট সাময়িক সময়ের জন্য বাতিল করা হয়েছে।
সিবিসি দেশটির নিরাপত্তা সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে লিখেছে, ইরানের সামরিক স্থাপনায় হামলা হয়েছে। কোনো পারমাণবিক বা তেল স্থাপনায় হামলা হয়নি। এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি।
ইরান গত ১ অক্টোবর ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে অন্তত ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে বলে দাবি করেছিল তেহরান।
ইসরাইলের হাতে ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন, তাদের হামলায় হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ, আইআরজিসি কমান্ডার আব্বাস নিলফোরুশনের নিহত হওয়ার ঘটনা এবং লেবানন ও ফিলিস্তিনের নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুদের রক্তপাতের জবাব দিতে ওই হামলা করার দাবি করেছিল আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দেশ।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দেশ ইসরায়েল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা রুখে দেওয়ার দাবি করলেও তাদের পক্ষ থেকে এর জবাব দেওয়ার ঘোষণা আসে এবং তাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও পায়। সেই হামলার ২৫ দিনের মাথায় ইরানকে জবাব দিল ইসরায়েল।