বাঙালি স্বভাবত ভদ্র নয়। সুবিধা আদায়ের সময় বাঙালি অনুনয় বিনয়ের শেষ সীমায় যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত অন্যদের সাথে ভদ্র আচরণ করে না। বাঙালি প্রতিটি অচেনা মানুষকে মনে করে নিজের থেকে ছোটো, আগন্তুক মাত্রকেই মনে করে ভিখিরি। কেউ এলে বাঙালি প্রশ্ন করে ‘কী চাই?’ অপেক্ষা করার জন্য বলে ‘দাঁড়ান’। কোন কর্মক্ষেত্রে গেলে বাঙালির অভদ্রতার পরিচয় চমৎকারভাবে পাওয়া যায়।
যিনি কোনো আসনে বসে আছেন কোনো কর্মস্থলে, তাঁর কাছে অচেনা মানুষ গেলে তিনি সুব্যবহার পাবেন না, এটা বাঙালি সমাজে নিশ্চিত। আসীন কর্মকর্তা, তিনি যতো নিম্নস্তরেই থাকুন না কেনো, তিনি আগুন্তুকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলের কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগন্তুকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোনো আসন থাকলেও আগন্তুককে বসতে বলবেন না। বাঙালি অন্যকে অপমান ক’রে নিজেকে সম্মানিত করে। পশ্চিমে এটা কখনো হয় না। পশ্চিমে সাক্ষাৎ প্রার্থী সাদরে গৃহীত হয়, সম্মানিত হয়; কিন্তু বাঙলায় প্রতিটি সাক্ষাৎ প্রার্থী হয় অপমানিত।
বাঙলায় সম্মানলাভের বড়ো উপায় হচ্ছে ক্ষমতা। কোথাও গিয়ে তাই প্রথমেই নিজের পদের পরিচয় দিতে হয়, ঐ পদটি,যদি আসীন ব্যক্তিকে সন্ত্রস্ত করে, তাহলে সাক্ষাৎ প্রার্থী যথেষ্ট সমাদর লাভ করেন। তাই বাঙালি সামাজিকভাবে ভদ্র ও সৌজন্য পরায়ণ নয়; তার সৌজন্য ভীতি বা স্বার্থ চেতনা প্রসূত বাঙালি যখন পথে ঘাটে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখনও ঠিক সৌজন্য বিনিময় ঘটে না। ধর্মীয় সম্বোধন অনেকে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক’রে থাকে, তবে তা যতোটা যান্ত্রিক, ততোটা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নয়। পশ্চিমে রাস্তায় বেরিয়েই পরিচিত জনের, সামান্য পরিচিতের, হাসিমুখ দেখা স্বাভাবিক ঘটনা;
কিন্তু এখানে হাসিমুখ দুর্লভ;
রেষারেষি বাঙলায় আলোবাতাসের মতো সত্য।
প্রতিটি এলাকা পারস্পরিক রেষারেষিতে গোপন
যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ভয়ঙ্কর এখানে। তাই সামাজিক
ভদ্রতা দুষ্প্রাপ্য। বাঙালি সমাজ প্রতি মুহূর্তে
ক্ষমতানিয়ন্ত্রিত; প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি ক্ষমতারূপে বিরাজ করে, চলাফেরা করে। ক্ষমতা কোনো ভদ্রতা জানে না। ক্ষমতার দুটি দিকে রয়েছে;- একটি দম্ভ, তা শক্তিমানকে দাম্ভিক করে; আরেকটি অসহায়ত্ব, তা অধীন ব্যক্তিকে স্তাবকে পরিণত করে। তাই বাঙালি দাম্ভিক বা স্তাবক, ভদ্র নয়।
বাঙালি একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠী :হুমায়ুন আজাদ।
হুমায়ূন আজাদ স্যারের উপরের ঐ কথাগুলোর সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি যদি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, আমি যখন দেশে যাই, অফিসগুলোর কথা বাদ দিলাম যখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে যখন যাই, প্রায়ই লোকাল সেলিব্রেটিরা মেকাপ রুমে থাকেন, ঐ রুমে ঢুকতেই উনারা এমনভাবে মুখ সরিয়ে নেন এবং এমন ভাবে পাশে থাকা অন্যান্য মানুষদের সাথে কথা বলেন যে, রুমে একজন নতুন প্রবেশকারী (আমি) এক্সিস্ট করিনা, আমাকে ভেদ করে যেনো অন্যান্যদের সাথে কথা বলেন , তখন নিজেকে প্রায়ই ভুত-প্রেত মনে হতো , মনে হতো আমি হয়তো অদৃশ্য কেউ, আমাকে মনে হয় দেখা যায় না। মেকাপ আর্টিস্টরা ব্যস্ত থাকেন তাদেরই সাজানোতে। অথচ, আই-টু-আই যোগাযোগে কিংবা মুখে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে যে গ্রিটিংস জানানো যায়, স্বাগত জানানো যায় , উনারা অনেকেই হয়তো জানেনই না।
আরেকটা ভয়াবহ ব্যাপার লাগে তাহলো, কোন দরজা দিয়ে যাওয়ার সময়, সামনের মানুষটি একবারও পিছনে ফিরে তাকায় না যে, দরজাটি কারোর নাকের উপর গিয়ে বন্ধ হচ্ছে কিনা। আমি যা পশ্চিমাদের থেকে শিখেছি, দরজাটি ধরে পিছনে ফিরে তাকানো, কেউ পিছনে কাছাকাছি থাকলে সেই ব্যক্তি দরজাটি ধরলেই হাত সরিয়ে চলে যাওয়া। সেই ক্ষেত্রে দেশের প্রেক্ষাপটে আমার সাথে যা হয়, আমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছি আর লোকগুলো সব যেতেই থাকে যেতেই থাকে, দরজা ধরার কোন নামগন্ধ থাকে না। আর মহিলাগুলো যেতে যেতে আমাকে এমন লুক দেয় যেমন, ”বেটি তুই একটা”।
লেখক: মাকসুদা আক্তার প্রিয়তী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইরিশ পাইলট, সাবেক মিস আয়ারল্যান্ড ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব