দারুণ জয়ে সিরিজ ড্র করার পর হাসিমুখে টিম বাংলাদেশ।
সময়টা ছিল ২০০৯ সাল। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সঙ্গে একঝাঁক ঊনিশ-কুড়ির তরুণ। বাংলাদেশ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে গেলেও স্বাগতিকরা অপ্রস্তুত।
বোর্ডের সঙ্গে পারিশ্রমিক নিয়ে জটিলতায় সিনিয়র ক্রিকেটাররা বেঁকে বসেছিল। বোর্ডও ছাড় দেয়নি। দ্বিতীয় সারির দলকে নামিয়ে দেয় বাংলাদেশের বিপক্ষে। তাতে বাংলাদেশ হয়ে যায় হট ফেভারিট। মাঠের ক্রিকেটে সেই দাপট টিকিয়ে রাখে অতিথিরা। জিতে নেয় কিংসটন টেস্ট। এরপর জিতে নেয় সিরিজও।
১৫ বছর পর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের পেছনের গল্পগুলো ছিল এমন। গতকাল কিংসটনে বাংলাদেশ যখন তৃতীয়বার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাটিতেই হারাল তখন ঘুরে ফিরে আসছিল সেসব কথা। দ্বিতীয় সারির দলকে হারিয়েছিল, সেই কথাও উঠেছিল। কিন্তু এবার জয়ের পেছনে ছড়ি ঘোরানোর মতো কিছুই নেই। বরং রয়েছে গর্ব করার মতো অনেক রসদ।
ইয়ান বিশপ সব সময়ই বাংলাদেশের ক্রিকেটের আনন্দের সময়ে পাশে থাকেন। শব্দের মুগ্ধতা ছড়িয়ে প্রশংসা করেন। এবারও করলেন। নাহিদ রানার ফুলার লেন্থের বলে সামার জোসেফ বোল্ড হলে কথার ঝাঁপি খুলে দেন বিশপ, “অসাধারণ এক জয়ে টেস্ট সিরিজের সমাপ্তি হলো। যা বাংলাদেশকে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০০৯ সালের পর প্রথম জয়ের স্বাদ দিলো। সঙ্গে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ ড্র। প্রথম টেস্ট যেভাবে হেরেছিল, দ্বিতীয় টেস্ট ঠিক সেভাবে জিতল, কুর্নিশ তো করতেই হবে তাদেরকে। এভাবে ফিরে আসা, দাপট দেখানো, অধিনায়কত্বে সাহস দেখানো সত্যিই অপূর্ব।”
২৮৭ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়ে বাংলাদেশ ১০১ রানে জিতে নেয় কিংসটন টেস্ট। প্রথম টেস্টে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর দ্বিতীয় টেস্টের শুরুটাও ছিল বাজে। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের দারুণ গল্প লিখে, ফিরে আসার অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতে নিয়েছে সাহস দেখিয়ে।
ম্যাচ জয়ের ছবি তৃতীয় দিনেই আঁকছিল বাংলাদেশ। স্কোরবোর্ডে ছিল ২১১ রানের লিড। সকালের সেশনে বাংলাদেশের ব্যাটিং কতদূর যায় তার ওপর নির্ভর করছিল সব কিছু। উইকেটে জাকের আলী থাকায় কিছুটা আশা ছিল। শেষ পর্যন্ত তার ব্যাটেই ছড়ায় আলো।
চতুর্থ দিনে স্কোরবোর্ডে আরো ৭৫ রান যোগ করে বাংলাদেশ। যার ৬২ রান-ই আসে জাকেরের ব্যাট থেকে। টানা তিন টেস্টে ফিফটি ছুঁয়ে ডানহাতি ব্যাটসম্যান এগিয়ে যাচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মিছিলের মাঝে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে রান তুলছিলেন। কিন্তু শেষ হাসিটা হাসতে পারেননি।
পেসার আলজারি জোসেফের শর্ট বল তুলে মারতে গিয়ে মিড উইকেটে ক্যাচ দেন। অথচ এর আগে কেমার রোচ, আলজারি জোসেফ ও সামার জোসেফদের বল অনায়াসে উড়িয়েছেন তিনি। ভাগ্যবিধাতা চায়নি বলেই ৯১ রানে থেমে যেতে হয় তাকে। এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটি খেলতে ৮ চার ও ৫ ছক্কা হাঁকিয়েছেন জাকের।
তাইজুল নিজের কাজটা ঠিকঠাক করলেও হতাশ করেছেন আটে নামা মুমিনুল। আবারো রানের খাতা খুলতে ব্যর্থ সাবেক টেস্ট অধিনায়ক। টানা দুই ইনিংসে শূন্য মেরে পেয়েছেন ‘পেয়ারের’ তিক্ত স্বাদ। এর আগে ২০১৯ সালে ইডেনে গোলাপী বলের টেস্টেও ‘পেয়ার’ হয়েছিলেন মুমিনুল।
প্রথম ইনিংসে ১৬৪ রান করা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে করে ২৬৮ রান। তাতে লিড হয় ২৮৭ রানের। এর আগে কিংসটনে মাত্র দুইবার দুইশর বেশি রান তাড়া করে ম্যাচ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সর্বোচ্চ ছিল ২১২। তাই ইতিহাস বাংলাদেশের পক্ষেই ছিল। এবারও পাল্টায়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুই সেশনের মধ্যে ১৮৫ রানে আটকে বাংলাদেশ অনায়াসে জয় তুলে নেয়।
মধ্যাহ্ন বিরতির আগে ৪.২ ওভার হাত ঘুরানোর সুযোগ পায় বাংলাদেশ। শেষ ওভারেই তাইজুলের হাত ধরে আসে ব্রেক থ্রু। নতুন বলে তাইজুল নিজের কার্যকারিতা দেখান। ফেরান ওপেনার মিকাইল লুইসকে। বিরতির পর স্বাগতিকরা প্রতিরোধ গড়েছিল। অধিনায়ক ব্র্যাথওয়েট ও কেসি কার্টি প্রতি-আক্রমণে গিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখেন। চাপ জমতে দেননি।
জয়ের নেশায় মগ্ন বাংলাদেশকে অবশ্য আটকে রাখা যায়নি। তাসকিন নিজের দ্বিতীয় স্পেল করতে এসে তুলে নেন কার্টির উইকেট। নিখুঁত লাইন ধরে ধারাবাহিক বোলিং করে যাচ্ছিলেন তাসকিন। ব্যাটের কানায় ‘লাগছে লাগছে’ করেও লাগছিল না। তবে পুরস্কারের জন্য বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। কার্টির ব্যাটে চুমু খেয়ে বল যায় লিটনের কিপিং গ্লাভসে।
বাংলাদেশের পথের কাঁটা হতে পারতেন ব্র্যাথওয়েট। তাকে ফেরানোর জন্য দরকার ছিল বিশেষ কিছু। তাইজুল ও শাহাদাতের হাত ধরে আসে সফলতা। বাঁহাতি স্পিনারের ছোবল দেওয়া ডেলিভারী ব্র্যাথওয়েটের গ্লাভস ছুঁয়ে যায় স্লিপে। সেখান শাহাদাত ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ নিয়ে দলকে আনন্দে ভাসান। নতুন ব্যাটসম্যান আথানজেকেও টিকতে দেননি বাঁহাতি স্পিনার। এক ওভার পরই বোল্ড করে তাকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখান।
দ্বিতীয় সেশনে ৩ উইকেট তুলে বাংলাদেশ জয়ের পথে আরেকটু এগিয়ে যায়। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে ফিফটি তুলে পাল্টা জবাব দেন হজ। রানার শর্ট বলে পুল করে বাউন্ডারি মেরেছেন। তাসকিনের বল ড্রাইভ করে পাঠিয়েছেন সীমানায়। মিরাজ ও তাইজুলকে খেলেছেন দেখেশুনে। তার ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল বড় মিশন নিয়েই এসেছেন। কিন্তু তাইজুলের জ্বলে ওঠার দিন হজ ফিফটি করেই বিদায় নেন। আর্ম ডেলিভারী জোড়া পায়ে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হন হজ (৫৫)। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি।
এরপর বাংলাদেশের সামনে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। জয়ের মঞ্চে তাইজুল পেয়ে যান ফাইফারের স্বাদ। তাসকিন যখনই ফিরেছেন দিয়েছেন উইকেটের স্বাদ। হাসান মাহমুদও পকেটে পুরেছেন উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন ম্যাচের মোড় পাল্টে দেওয়া নাহিদ রানা।
ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছে দলীয় পারফরম্যান্সে ভর করে। প্রথম ইনিংসে নাহিদের আগুনে বোলিং। দ্বিতীয় ইনিংসে সাদমান-শাহাদাত-মিরাজের দায়িত্বশীল ব্যাটিং। জাকেরের “সেঞ্চুরি সমান” ঝকঝকে ৯১ রান এবং বোলিংয়ে ফাইফার নিয়ে তাইজুলের অভিজ্ঞতার সবটুকু মেলে ধরা; স্রেফ অসাধারণ, অপূর্ব বাংলাদেশ। শেষ কয়েক টেস্টে লড়াইয়ের মানসিকতা, টেস্ট জয়ের ক্ষুধা, শরীরী ভাষায় নিবেদনের ঘাটতি ছিল। ১৫ বছর পর কিংসটন সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছে উপহারের ডালা সাজিয়ে।