মংলা বন্দর
ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা উপকূলে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। সেই সাথে বেড়িবাঁধ ভাঙার আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলবাসী।
অপরদিকে, মোংলা বন্দর ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে। চলছে লাগাতার বৃষ্টি, বাড়ছে বাতাসের তীব্রতাও। ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে রক্ষা ও মানুষের জানমাল রক্ষায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সকাল থেকে খুলনা উপকূলজুড়ে বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া বইছে। বিকেলেও সূর্যের দেখা মেলেনি। সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে আতঙ্ক বাড়ছে স্থানীয়দের মাঝে। বসত বাড়ি, গবাদি পশু ও মৎস্য ঘের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। বেড়িবাঁধ ভাঙার আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা।
খুলনা
ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে খুলনায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কোনো ধরনের ঝড়ো হওয়া না থাকলেও হিম শীতল বাতাস বইছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও আকাশ মেঘে ঢেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চারদিক। সন্ধ্যা নাগাদ বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মো. আমিরুল আজাদ জানান, রাতে বৃষ্টি, ঝড়ো ও দমকা হওয়ার পরিমাণ বাড়তে পারে। ঝড়ের প্রভাবে দমকা ও ঝড়ো হাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড়কালে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে জেলায় ৬০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। কেন্দ্রগুলোয় মানুষের অবস্থান করার মতো পরিবেশ নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে। খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেসব স্থানে নজর রেখে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে। দুর্যোগকালে স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, আইনশৃঙ্খলারক্ষার মতো জরুরিসেবা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে সম্ভাব্য দুর্যোগ বিবেচনায় নিয়ে খুলনা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি সভা করে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় সতর্কমূলক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সাইক্লোন শেল্টারগুলোও প্রস্তুত রয়েছে। ঝড়ের অবস্থা বুঝে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
মোংলা
সংকেত বাড়ার সাথে সাথে মানুষকে সচেতন ও দুর্যোগ চলাকালীন সময় মানুষদের উদ্ধার, আশ্রয় দেওয়া ও প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ পরিচালনার জন্য সিপিপির ১ হাজার ৩২০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকাসহ বিদ্যুৎ বিভাগ সড়ক বিভাগ ফায়ার সার্ভিসকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ ছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ স্যালাইন, ওষুধ ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সংরক্ষরসহ উপজেলায় মোট ২৮টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নদী সংলগ্ন এলাকার ঝুকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের দিকে নজর রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। দুর্যোগের সময় কোথাও ভাঙন দেখা দিলে তা মেরামতের জন্য শ্রমিকসহ জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখার জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে মোংলা উপজেলা প্রশাসন।
এদিকে, বর্তমানে মোংলা বন্দর চ্যানেলে পণ্য খালাসের জন্য ৮টি বাণিজ্যিক জাহাজ অবস্থান করছে। সে সকল জাহাজ নিরাপদে গিয়ে শক্ত অবস্থানে নোঙ্গর করে থাকার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নিজস্ব এলার্ট-১ সহ বন্যা দুর্গত মানুষের আশ্রয় ও উদ্ধারের জন্য সকল নৌযান প্রস্তুত রেখেছে বন্দর। দুর্যোগের বিপৎকালীন মানুষের সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
ঘূর্ণিঝড় দানার খবরে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিদেশি জাহাজ ও সকল প্রকার যোগাযোগ রক্ষার জনন্য খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এখন পর্যন্ত বন্দরের সকল কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড ও গণসংযোগ বিভাগের উপ-সচিব মো. মাকরুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় দানার খবর ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। জাহাজগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। বন্দরে এখন নিজস্ব ১ নম্বর এলার্ট চলছে, তিন পর্যন্ত বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে বলেও জানান তিনি।’
বাগেরহাট
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার রোমজাইপুর গ্রামের মো. তুহিন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় কোনো বেড়িবাঁধ নেই। বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক জোয়ারে বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করে। ঝড়ে কি হবে জানি না, আশ্রয়কেন্দ্রও অনেক দূরে।’
পেরিখালী ইউনিয়নের নারী ইউপি সদস্য হেনা বেগম বলেন, ‘রামপালে ও মোংলা উপজেলার বেশিরভাগ অংশ বেড়িবাঁধের বাইরে। যেকোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এই এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দানার খবরে সবাই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। আমরাও মানুষকে সচেতন করছি। যাতে মানুষের জান মালের ক্ষতি কম হয়।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মাদ আল বেরুনী বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ ও ব্লক প্রস্তুত আছে। বিভিন্ন পোল্ডারের বাঁধগুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। ৩৫/১ পোল্ডারের বাঁধে শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী অংশে ৫০০ মিটারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। প্রয়োজনে জরুরি মেরামত করা হবে। এ ছাড়া মোরেলগঞ্জ, মোংলা ও রামপালের বেশকিছু এলাকায় বেড়িবাঁধ নেই। তাদেরও সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে।’
ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জরুরি সভা করেছে জেলা প্রশাসন। উপকূলের মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে জেলায় ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলায় ৮০০ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
এ ছাড়া শিশুখাদ্য জন্য ৫ লাখ ও গো-খাদ্যের জন্য ৫ লাখ টাকা নগদ বরাদ্ধ রাখা হয়েছে। আপৎকালীন মানুষদের সহযোগিতার জন্য ৩ হাজার ৫০৫ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রয়েছে। ৮৪টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল আহসান।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে জরুরি সভা করেছি। জেলা পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা ও দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে শিশু, নারী ও গর্ভবতী নারীদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। গবাদি পশু ও মাছের ঘেরগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে। সবাইকে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলার অনুরোধ করা হয়েছে।’
সাতক্ষীরা
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) ভোর রাত থেকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকাসহ জেলার সর্বত্রই থেমে থেমে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝে বইছে দমকা হাওয়া। উপকূলের নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় দানা মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন। পরিস্থিতি মোকবেলায় ও দুর্গত মানুষের পাশে থাকার জন্য সাতক্ষীরার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বুধবার (২৩ অক্টোবর) বিকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
শ্যামনগরের আফজাল হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে বইছে দমকা হাওয়া। উপকূলের সব নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তবে এখনো পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান তিনি।
শ্যামনগর উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. শাহিনুল আলম জানান, সব চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলার উপকূলীয় শ্যামনগর এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ মোকাবেলায় উপজেলার সরকারি ১০২টিসহ মোট ১৬২টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনা খাবার মজুদ রাখা রয়েছে। উপকূলীয় এলাকার মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য দুই হাজার ৯৮০ জন সিপিপি সদস্যসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকরা প্রস্তুত রয়েছেন।
এদিকে উপকূলীয় এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা। বেড়িবাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট-গুলোতে পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ, জিও রোল-সহ অন্যান্য অনুসাঙ্গিক সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন পাউবো কর্মকর্তারা।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন জানান, তার বিভাগের আওতাধীন ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি পয়েন্টে আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ, জিও ফিল্টার, জি পলেস্টার মজুদ করে রেখেছি। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মনিরুল ইসলাম জানান, তার বিভাগের আওতাধীন প্রায় সাতক্ষীরায় ৩০৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি পোল্ডারের ৩টি পয়েন্টে ২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যাক জিও ব্যাগ, ফিল্টার ও জি পলেস্টার মজুদ রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগাম বার্তা পাওয়ার পর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের উপর নজর রাখা হয়েছে। লোকজন তাদের স্ব স্ব এলাকায় কাজ করছেন। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত রযেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। সাতক্ষীরায় ৮৮৭টি সাইক্লোন শেল্টার ও আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেখানে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবেন। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ মোকাবিলার সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৫ লাখ টাকার গো খাদ্য, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য, ৮০০ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ অর্থ প্রায় ৭ লাখ টাকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, ট্রলার ও স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’